http://themonthlymuktidooth.blogspot.com

Wednesday, October 5, 2011

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক এ ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, এ কথা আদৌ সঠিক নয় urgument on Care Taker government

Moniruzzaman Mian
October 5, 2011, 2:28 pm


আমার স্মৃতি যদি আমাকে বিভ্রান্ত না করে, আমার মনে হয়, নির্বাচন অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা প্রথম আসে জামায়াতে ইসলামী নামক দলের প্রধান গোলাম আযমের একটি মুদ্রিত লিফলেট থেকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় আমাদের বাসায় বাসায় দরজার নিচ দিয়ে বিতরণ করা হয়েছিল। ঘটনাটি আশির দশকের প্রথম দিকের কোনো এক সময়ের। ওই সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তাঁর ক্ষমতা গ্রহণকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়ার জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন।





রাষ্ট্রপতির দেওয়া সেই টোপ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গলাধঃকরণও করেছিলেন, আবার উদগিরণ করেছিলেন। কিন্তু বিগত দিনের সেসব কথা এখনকার সংকটময় মুহূর্তে না আনাই ভালো।






সে যা-ই হোক, সে সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তৎকালীন মিলিটারি শাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত জনমত গড়ে ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জোটভুক্ত হয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সম্মত হয়। সব দলের সমঝোতার মাধ্যমে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এক অভিনব পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।






তাঁর তত্ত্বাবধানে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল বিএনপি ১৪০টি আসনে নির্বাচিত হয়ে সংসদে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে সরকার গঠন করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, রাজনীতিতে নবাগত খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দলের এই বিপুল বিজয়ের কারণ তাঁর সামরিক শাসনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ। যে জন্য তিনি বারবার এরশাদের প্রস্তাবিত নির্বাচন বর্জন করেছেন। তাঁর এই অনমনীয়তা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর সংবিধান সংশোধন করে আবার সংসদীয় সরকার পদ্ধতি ফিরিয়ে আনেন। অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তাঁর সরকার যথেষ্ট সফলতা অর্জন করে। গ্রামগঞ্জে বিবিধ ক্ষেত্রে বিএনপি সরকারের অর্জন বিস্তারিত উল্লেখ করা থেকে আমরা বিরত থাকতে চাই।






১৯৯৩, '৯৪ ও '৯৫ সালে আমি দেশের বাইরে কূটনীতিকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম। যে গুটিকয় পত্রপত্রিকা ডিপ্লোম্যাটিক ব্যাগের মধ্যে দূতাবাসে পাওয়া যেত, সেগুলোই ছিল দেশের খবর জানার উৎস। ১৯৯৩ সালের শেষের দিকে অথবা '৯৪-এর প্রথম দিকে হঠাৎ করে এক পত্রিকায় দেখলাম তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন শুরুর খবর। এই আন্দোলন তুঙ্গে যখন উঠেছে, তখন কমনওয়েলথ সেক্রেটারি চিফ এমেকা এলেন ঢাকায়। তিনি আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের দুই বিশিষ্ট মহিলার সঙ্গে চলতি সংকট ও তার থেকে উত্তরণের বিষয় আলোচনা করলেন। পরে তিনি লন্ডনে ফিরে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অথবা সেই সময় গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়োজিত স্যার নিনিয়ানকে তাঁর প্রতিনিধি করে পাঠালেন।





স্যার নিনিয়ান ব্যাপক আলাপ-আলোচনাও করলেন, কিন্তু একদিন এক সংবাদ সম্মেলন করে যা বললেন, তা মোটামুটি এ রকম:






'সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর আমি কিছু প্রস্তাব রেখেছিলাম।' তিনি আরো বললেন, 'আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই প্রস্তাবে যদি সবাই সম্মত হতো এবং এগুলো যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে বর্তমান অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব হতো।' প্রসঙ্গক্রমে স্যার নিনিয়ান জানালেন যে সরকারপক্ষ তাঁর প্রস্তাব মেনে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তিনি কিছুটা হতাশা প্রকাশ করে কনফারেন্স ত্যাগ করেন এবং সস্ত্রীক বাংলাদেশে এক মাস অবস্থানের পর ১৪ নভেম্বর স্বদেশে ফিরে যান। আওয়ামী লীগ অবশ্য স্যার নিনিয়ানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।






কেমন ছিল আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও আরো কয়েকটি দল-সহযোগে আন্দোলনের রূপ? এ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার, যা নিম্নে বর্ণিত হলো।



বিভিন্ন সময় পালিত হরতাল, অবরোধ ইত্যাদির তারিখসহ বিবরণ দেওয়া হলো-





১৯৯৪ সাল



২৬ এপ্রিল (হরতাল), ১০ সেপ্টেম্বর (অবরোধ), ১১, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর (হরতাল), ২৭ সেপ্টেম্বর (অবরোধ), ৩০ নভেম্বর (অবরোধ), ৭ ও ৮ ডিসেম্বর (হরতাল), ২৪ ডিসেম্বর অবরোধ, ২৯ ডিসেম্বর (অবরোধ)।




১৯৯৫ সাল

২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি (হরতাল), ১৯ জানুয়ারি (অবরোধ), ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি (হরতাল), ১২ ও ১৩ মার্চ (লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল), ২৮ মার্চ (ঢাকা অবরোধ), ৯ এপ্রিল (৫ বিভাগে হরতাল), ২ ও ৩ সেপ্টেম্বর (লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল), ৬ সেপ্টেম্বর (সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ১৬, ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর (লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল), ৭ ও ৮ অক্টোবর (পাঁচ বিভাগে লাগাতার ৩২ ঘণ্টা হরতাল), ১৬, ১৭, ১৮ ও ১৯ অক্টোবর (লাগাতার ৯৬ ঘণ্টা হরতাল), ৬ নভেম্বর (ঢাকা অবরোধ), ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর (প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ৯, ১০ ও ১১ ডিসেম্বর (লাগাতার ৭২ ঘণ্টা হরতাল), ১৭ ডিসেম্বর (সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ৩০ ডিসেম্বর (দেশব্যাপী অবরোধ)।




১৯৯৬ সাল

৩ ও ৪ জানুয়ারি (লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল), ৮ ও ৯ জানুয়ারি (লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতাল), ১৭ জানুয়ারি (সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ২৪ জানুয়ারি (সিলেটে ১১ ঘণ্টা হরতাল), ২৭ জানুয়ারি (খুলনায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ২৮ জানুয়ারি (খুলনায় অর্ধদিবস হরতাল), ২৯ জানুয়ারি (ঢাকায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ৩০ জানুয়ারি (চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল), ১ ফেব্রুয়ারি (বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় হরতাল), ৩ ফেব্রুয়ারি (অর্ধদিবস হরতাল), ৭ ফেব্রুয়ারি ফেনীতে (সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত হরতাল), ৮ ফেব্রুয়ারি (ফেনীতে হরতাল), ১০ ফেব্রুয়ারি (রাজশাহীতে হরতাল), ১১ ফেব্রুয়ারি (সিরাজগঞ্জে হরতাল), ১৩ ফেব্রুয়ারি (দেশব্যাপী অবরোধ), ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি (দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টা লাগাতার হরতাল), ২৪, ২৫, ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি লাগাতার (অসহযোগ), ৯ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত লাগাতার ২২ দিন অসহযোগ।








এসব কর্মসূচির খবর সে সময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো:





অবরোধ সংঘর্ষ: পুলিশ সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ





স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শনিবার রমনা, বিজয়নগর, পুরানা পল্টন, জিরো পয়েন্ট ও গুলিস্তান এলাকায় সংঘর্ষে ১১ জন পুলিশ, কয়েকজন সাংবাদিকসহ বহু লোক আহত হয়েছে।




দুটি দলের আহূত কর্মসূচি চলাকালে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য পুলিশ বাংলাদেশ সচিবালয়ের চারদিক, মৎস্য ভবন, হাইকোর্ট মাজার, পল্টন মোড়, বিজয়নগর, গোলাপ শাহ মাজার ও জিপিওর সামনে ব্যারিকেড দেয়। অবরোধ আহ্বানকারী আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কর্মীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগোনোর জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে সহিংসতার আশ্রয় নেয়। পুলিশ তাদের ঠেকাতে গেলে তারা নির্বিচারে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে। পল্টন মোড়ে জাতীয় পার্টির কিছু কর্মী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দেয়ালের বেশ কিছু অংশ ভেঙে ফেলে। গুলিতে আহত ফটোসাংবাদিক শাহাদাত হোসেন ইবনে সিনা ক্লিনিকে চিকিৎসা নেন। কনস্টেবল শহীদুল ইসলামকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে (দৈনিক বাংলা, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪)।




নির্বাচনবিরোধীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যালট বাঙ্ ও ভোটের সরঞ্জাম লুটপাট, ভোটকেন্দ্র ও প্রার্থীর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। কোনো কোনো জায়গায় প্রিসাইডিং অফিসারদের অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে।...(দৈনিক বাংলা, ১৬ ফেব্রুয়ারি '৯৬)।




প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নির্বাচনী সফরের প্রতিবাদে খুলনা ও বাগেরহাটে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানে ২৭ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। হরতাল চলাকালে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে খুলনায় কামাল (১৪) নামের একজন নিহত ও ৭৫ জন আহত হয়।




প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর নির্বাচনী এলাকা ফেনী সফরের প্রথম দিন ৬টা-৩টা হরতাল ও কালো পতাকার সম্মুখীন হন। তাঁর গাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াত এ হরতালের ডাক দেয় (দৈনিক সংবাদ, ৮ ফেব্রুয়ারি '৯৬।








কিন্তু কেন এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল? এর উত্তর খুবই সহজ ও সরল। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা যেমন ছিল না, তেমনি তা সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে প্রতিষ্ঠিত করাও সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে যেহেতু আন্দোলনকারীদের সব সংসদ সদস্য (১৪৭ জন) পদত্যাগ করেছিলেন, সেহেতু সংবিধানের সংশোধনী আনয়নও সম্ভব ছিল না। কেননা ওই পবিত্র দলিলটির মৌলিক কোনো বিষয় সংশোধন করতে হলে প্রয়োজন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি। বিএনপি সরকার তাই নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ পুনর্গঠিত করে সংবিধানে সংশোধনী আনয়নের উদ্দেশ্যে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন করে নির্বাচন বানচালের সিদ্ধান্ত নিল। প্রাণভয়ে স্বভাবতই খুব বেশিসংখ্যক ভোটার এলেন না ভোটকেন্দ্রে। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না সরকারি দলের হাতে। সরকার বিরাট ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে, তা তো আর পেছানো যায় না। তাই সরকার গঠন করে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁর এবং তাঁর সরকারের পদত্যাগপত্র দাখিল করলেন। বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে তিনি এক বিশাল সমাবেশে বক্তব্য দিলেন। সমাবেশের জনসমাগম থেকে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা যে কিছু কমেনি তা বোঝা গেল।






যে দল তাদের সহযোগী অন্য কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য দেশে একটি লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিল, সেই দলটি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায়, তখন বলছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যেহেতু উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছেন, তখন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে কিছু করা সম্ভব নয়_এ যুক্তি যে অচল তা আইন বিশেষজ্ঞরাই বলছেন। প্রকৃতপক্ষে কদিন আগে টিভিতে দেখলাম, এ বিষয়ে আলোচনার সময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মতো খ্যাতনামা আইনবিদ অত্যন্ত স্পষ্ট করে বললেন যে রায়ে এ কথাও বলা আছে যে আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনাধীন হতে কোনো বাধা নেই।






তা ছাড়া এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণের অবগতির জন্য আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করা দরকার, সেগুলো হচ্ছে এই যে_তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি এর আগে হাইকোর্টে দুইবার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল এবং দুইবারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়। ২০০৪ সালে পুনরায় সর্বশেষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। তারই রায় এটি, যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে চারজন মাননীয় বিচারক এ রায়ের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তিনজন এর বিরোধিতা করেন, অর্থাৎ তা সর্বসম্মত রায় নয়।






এ ছাড়া মহামান্য আদালত তাঁদের সাহায্যার্থে পরামর্শদানের জন্য যে আটজন অ্যামিকাস কিউরি নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেবল একজন ছিলেন বাতিলের পক্ষে, বাকি সাতজনই ছিলেন বিপক্ষে। অর্থাৎ আইনবিদরাও এ বিষয়ে একমত হননি বরং বেশির ভাগই এর বিরোধিতা করেছেন।






কথা আরো আছে, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো_সর্বোচ্চ আদালতই বলেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও অন্তত আরো দুইবার এ ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। তবে কোনো সময়ই বিচারকরা সংশ্লিষ্ট থাকবেন না। অতএব, এ ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে_এ কথা আদৌ সঠিক নয়।






এখানে আমরা আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, যে রায়ের কথা বারবার উল্লেখ করা হচ্ছে, তা কিন্তু সম্পূর্ণ লেখাও হয়নি, প্রকাশিত হওয়া তো দূরের কথা।






দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন_এটি নির্বাচনে ব্যবহারের বিষয়ে। হঠাৎ করেই দেখা গেল যে সরকারপক্ষ ও নির্বাচন কমিশন এমন একটি নতুন ব্যবস্থা নির্বাচনে নেবে বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ইভিএমের ভালো-মন্দ জনগণের কয়জন জানে? তাহলে কিছু শুনুন।






বর্তমান সরকারি দল ক্ষমতা গ্রহণের পর আড়াই বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সাধারণ অবস্থায় এ সরকারের ক্ষমতায় অবস্থানের কাল মোটামুটি আরো আড়াই বছর রয়েছে। তবে দেখা যাচ্ছে যে এর মধ্যেই সাধারণ নির্বাচনের রায়কে প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, ইতিমধ্যে প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি উচ্চ আদালত কর্তৃক বাতিল করা হয়েছে। আরেকটি পদ্ধতি সরকার গ্রহণ করতে যাচ্ছে এবং যে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনও খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে, তা হচ্ছে_নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ব্যবহার। এখানে উল্লেখ্য, বিভিন্ন দেশে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সীমিত এবং উন্নত বিশ্বের একটি দেশেও জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি পুরোপুরি ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমাদের দেশে এর ব্যবহার অনেক কারণে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংরক্ষণ করা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩০ হাজার ভোটকেন্দ্রে এ মেশিন প্রেরণের প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি না। এ ছাড়া এর ব্যবহার, বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণে এর বিশ্বাসযোগ্যতা কতখানি, এ নিয়ে অনেক সংশয় রয়েছে। কেননা প্রতিটি ইভিএমের ভেতরে যে কম্পিউটার প্রোগ্রাম থাকে, তা স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল কম্পিউটার জ্ঞানের সাহায্যে অতি সহজেই পরিবর্তন করতে পারে, যার দ্বারা নির্বাচনী ফলাফল পাল্টে দেওয়া সম্ভব। করিৎকর্মা কোনো ব্যক্তি যদি তা করতে চায়, তাহলে তা রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট_কারো পক্ষে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, সারা দেশের ৩০ হাজার পোলিং সেন্টারে যতসংখ্যক পোলিং বুথ থাকবে, এর জন্য প্রয়োজন হবে মোটামুটি তিন লাখ তথাকথিত এই মেশিন। এত বিপুলসংখ্যক ভোট বাঙ্রে টেকনিক্যাল নিরাপত্তা দেওয়া খুবই কঠিন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে হল্যান্ডের ভিম ভ্যান এক (ডরস ঠধহ ঊপশ) নামের এক গবেষক ১৯৮৫ সালে তাঁর এক গবেষণাপত্রে দেখান যে ৪০ মিটার দূর থেকে ইভিএমকে প্রভাবিত করা যায়। এ কারণে হল্যান্ডে ইভিএম পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও ভিম ভ্যান এক-এর গবেষণার পর তা আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সীমিত এবং উন্নত বিশ্বের একটি দেশেও জাতীয় নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএম পদ্ধতি এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের মতো দেশে এর ব্যবহার অযথাই যথেষ্ট সন্দেহ, সংশয়, বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি করবে। মূলত এ কারণে এই পদ্ধতি ব্যবহারের কোনো যৌক্তিকতাই নেই। অথচ এ বিষয়ে স্বার্থান্বেষী মহলকে যথেষ্ট আগ্রহী দেখা যাচ্ছে।








ইভিএম প্রযুক্তিটি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এবং বুয়েটের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মালিকানাধীন বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে সংযোজন করার কথা শোনা যাচ্ছে। অতঃপর মেশিনগুলো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে। নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সংরক্ষণ থেকে শুরু করে ৩০ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রেরণের পুরো প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা প্রদান সম্ভব নয়। এখানে উল্লেখ্য যে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সীমিত এবং উন্নত বিশ্বের একটি দেশেও জাতীয় নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএম পদ্ধতি এখন পর্যন্ত ব্যবহৃত হচ্ছে না। প্রতিটি ইভিএমের ভেতরে যে প্রোগ্রাম থাকে, তা যদি কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনায় পরিবর্তন করা হয়, তাহলে তা রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, প্রার্থী, পোলিং এজেন্ট_কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না। এ ছাড়া ব্লুটুথ বা ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এমনকি দূর থেকেও ইভিএমের ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। সব দিক বিবেচনায় বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতির ব্যবহার তাই সংগত কারণেই বিভিন্ন মহল দ্বারা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।






এ ছাড়া রয়েছে বর্তমান সরকার ক্ষমতারোহণের পর যেমন ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করছে, তা বিগত দিনে কখনো হয়নি। প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে যখন দলীয় সমর্থকদের উপস্থিতি, তখন যারা ডিসি, ইউএনও, টিএনও বা পুলিশ কর্মকর্তা থাকবেন সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচন কি সম্ভব? সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকেই প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের হোসেন হুংকার দিয়ে বলেছিলেন যে ছাত্রলীগ ছাড়া কাউকে কোনো চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হবে না। তাঁর সে কথাই যে ঘটছে, তা দেখাও যাচ্ছে। এর মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র জাল করার দায়ে। পরে জানা গেছে, তিনি ছাত্রলীগের কোটা থেকে নিয়োগ পেয়েছেন। এমন ধারার নিয়োগ সর্বক্ষেত্রে হয়েছে। ভিকারুননিসা গার্লস স্কুলের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি বিদ্যালয় আজ দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেছে। কিন্তু কেন? যদি স্কুল কমিটি সাহসী হয়, তাহলে জনসমক্ষে জানাক যে যাঁরা নতুন নিয়োজিত তাঁরা কারা, কোথায় তাঁদের বাড়ি, কে তাঁদের নিয়োগ দিয়েছে ইত্যাদি তথ্য।






আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে পুলিশের সাহায্য সব সময় প্রয়োজন। কিন্তু আজকের পুলিশের ক্ষমতার ব্যবহার কেমন? মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কত ব্যাপক এবং কিভাবে তা হচ্ছে?
মোটকথা, আমরা যা বলতে চাচ্ছি তা হলো এই যে বর্তমান দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় নির্বাচন নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে কেবল সংঘাতের সৃষ্টি করবে। আর তাই রাজনৈতিক বিষয়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হওয়াই কাম্য, যা সম্ভব সব রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও অন্যান্য জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর সমঝোতা আনয়নের মাধ্যমে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হবে না, তা স্বীকার করে আমাদের এগোতে হবে।

No comments: