সবকিছুই চলছে, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিছিলের পর মিছিল, চারিদিকে কবিতা উৎসব, কালো ব্যজ, কালো পোষাক, আর লাল-হলুদ ফুলের মিছিল যেন থামছেই না। অথচ বাতাসে লাশের গন্ধ। ঢাকা মেডিকেলের মর্গে পরে আছে অসংখ্য লাশের মিছিল। চকবাজারের চিরচেনা জনপথ যেন এক অগ্নিগিরি। কেউ চিৎকার করে কাঁদছে, আর কারো বোবা কান্না, কোথায় কোন শব্দ নেই শুধু চোখের পানি ঝরছে। কেউ সন্তান হারিয়েছে, কেউ বাবা হারিয়েছে, কেউ ভাই হারিয়ে, কেউ হারিয়েছে তাঁর প্রিয় স্বজন। পৃথিবীতে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হচ্ছে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ। কল্পনা করলেও কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যায়। আলতো আগুনের ছোয়া হাতে স্পর্ষ হলে উহ করে উঠি। কি নৃশংসভাবে নিরীহ মানুষ গুলো পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। চারিদিকে শোকের বিবৃতি আর সমবেদনার কান্না। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন কেউ বাদ যায়নি। তার পরেও কোন কিছু থেমে নেই। নিষ্ঠুর এই বাস্তবতার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। তার পরেও কিসের আমাদের অহংকার। কার জন্য প্রাসাদসম অট্টালিকা গড়ে তুলি। কার জন্য ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস রেখে দেই। আমার মৃত্যুর পর এই সব কিছুইতো সংগে যাবে না। তবে কেন ক্ষমতার এত বাহাদুরী। আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ ভাষা সৈনিক রফিক উদ্দিন আহমদ, আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, শফিউর রহমান তারা কি জন্য সেদিন পিচঢালা পথে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিল। একুশের আবেগ, একুশের কর্তব্য, ফাগুনের কৃষ্ণ চূড়ার ফুলের সৌন্দর্য্যে সেই প্রকৃতি আর সেই প্রেম কি আছে? সবার আগে দেশ এই মন্ত্র কয়জনের হৃদয়ে ধারণ করেছে। মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাঙলা ভাষা, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি। গান রয়েয়ে, সুর রয়েছে, শব্দ রয়েছে, শহীদ মিনারে মিছিলের পর মিছিল রয়েছে। দেশপ্রেম কই? সবকিছুই ঠিক ঠাক চলছে। কোন কিছুই থেমে নেই। পাষ- হৃদয় কিছুই দেখতে চায়না নিজের স্বার্থ ছাড়া। অথচ একদিন সবাই বিদায় নিতে হবে। নির্মম অগ্নিদগ্ধে ৭০ জনের বেশী লাশ হয়ে শুয়ে আছে। অপেক্ষায় আছে আরো কতজন, নিখোঁজের সংখ্যাও কম নয়। তারপরেও কিছু থেমে নেই। থামবে কেন? আমরা তো শোক বিবৃতি, সমবেদনা জানিয়েছি। স্বাধীনতার সাত্চল্লিশ বছর শেষ হয়ে গেলো। আমরা নতুন করে একজন বঙ্গবন্ধুকে সৃষ্টি করতে পারি নি। আমরা নতুন প্রজন্ম পাই নি। নতুন করে কোন শেরে-বাংলা, সরওয়ার্দী, ভাসানী, ওসমানী, নজরুল, কিংবা তর্কবাগিস। আমরা যাদেরকে পেয়েছি তারা তাদেরকে নিয়ে ব্যস্ত। জাতি গোল্লায় যাক। আমার কি, আমি তো ভালো আছি। সংকীর্নœতার ভাইরাসে আক্রান্ত সবাই। আমাদের কলম এখন জয় বাংলা জিন্দাবাদের কথা বলে। কলম কবে দেশের কথা বলবে, বলবে দশের কথা, এইতো সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদ না ফেরার দেশে চলে গেলো। তার মরদেহ আমরা শহীদ মিনারে নিতে পারি নি। পরিবারের শেষ ইচ্ছানুযায়ী বুদ্ধিজীবী কবরে তাকে দাফন করতে পারি নি। কবি শামসুর রহমানের পর বাংলাদেশের আধুনিক কবি আল মাহমুদ আর দ্বিতীয় কেউ আসে নি। শত্রুরাও স্বীকার করে তবে স্বীকৃতি নেই কেন? কবে আমরা সংকীর্ণতার বেড়াজাল ভাংতে পারবো। ছোট বেলায় একটি ডায়ালগ শুনে ছিলাম ‘আবার তোরা মানুষ হ’। তাহলে আমরা আজও মানুষ হতে পারি নি। বাবা মারা সন্তানদেরকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট বানাবার স্বপ্ন দেখে। মানুষ হওয়ার স্বপ্ন কবে থেকে দেখবে? খুব কষ্ট হচ্ছে, বাতাসে লাশে গন্ধ। চারিদিকে লাশ আর লাশ। আমাকে তো বিদায় নিতে হবে। কিছুই তো হতে পারলাম না। আত্মউপলব্ধি থেকে যদি মানুষ হতে পারি হয়তো অপ্রতাশিত্য আগুন আর কাউকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করবে না। কারণ মানুষ কখনোই অসচেতন নয়। যারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। আর যারা এখনো যাবার অপেক্ষায় রয়েছে তাদের কষ্টগুলো হৃদয়ে ধারণ করে এক সঙ্গে বলে উঠি সবার আগে দেশ। লেখক, জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান।
No comments:
Post a Comment