অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের ভাষায়, বাংলার রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে আজকের বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোক মাত্রেই পরোক্ষে গণশত্র“।’- আর বুদ্ধিজীবী মানেই ছদ্মবেশী জাতীয় শত্র“- ঠিক এরকম মন ভাবনা নিয়ে যদি সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করি, তাহলে জাতির অস্তিত্ব এবং স্বাধীনতাকেই সেক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হয়। আশির দশকে যখন স্বৈরাচারী শাসক-শোষকের বিরূদ্ধে উত্তাল আন্দোলন, মিছিল, সমাবেশ, জনসভা, আলোচনা-সমালোচনা- সেসময় একটা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সরব বিপ্লব ঘটে। তখন থেকেই প্রতিবুদ্ধিজীবীর একটা ধারণা জন্মে, সচেতন তারুণ্য সমাজ এগিয়ে আসে এই প্রতিবুদ্ধিজীবীদের সমন্বিত করতে এবং সংঘটিত করতে। বিশিষ্ট গল্পকার, গবেষক, অধ্যাপক সা’দাত উল্লাহ খানের ভাষায়, প্রতিবুদ্ধিজীবী হলেন তাঁরাই, যাঁরা সত্য বলেন, সত্য লেখেন এবং সত্যকে ভালবেসে, নিজের স্বার্থ ভুলে অন্যায় ও অবিচারের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে জেগে ওঠেন, ঐক্যবদ্ধ হন।’- একথার আলোকে তাই বলতে পারি, নিজেদের বিপদ ও ভয়কে উপেক্ষা করে, জয় করে পেছনের সব আবর্জনাকে ছুঁড়ে ফেলে, সামনের দিকে এগিয়ে যান যাঁরা, তাঁরাই প্রতিবুদ্ধিজীবী। ১৯৮৭ সালে তেমনি যে ক’জন প্রতিবুদ্ধিজীবী স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরূদ্ধে সাহসের সাথে সামনের কাতারে এগিয়ে আসেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন, কবি শামসুর রাহমান। এসময় সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে গোটা জাতিকে স্বৈরাচারীর বিরূদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করার একটা প্রয়াস- জাতীয় কবিতা পরিষদ। একদল তরুণ কবি, ছড়াকার ও সাংবাদিক ছিলেন এই জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনের প্রস্তাবক ও উদ্যোক্তা। কবি শাহনূর খান, ছড়াকার ও সাংবাদিক সালেম সুলেরীসহ কয়েকজন তরুণ এবং পরবর্তীতে কবি নির্মলেন্দুগুণ, কবি সাযযাদ কাদির, কবি তারিক সুজাত, কবি মোহন রায়হান প্রমুখের আন্তরিক প্রচেষ্টায় পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালেই প্রাতিষ্ঠানিক এবং সাংগঠনিক রূপ নেয় জাতীয় কবিতা পরিষদ। ঠিক সে সময়ের অবিসংবাদিত কবি সাংবাদিক শামসুর রাহমানকেই বেছে নেন তাঁরা, আর সমতল অবস্থান থেকে জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে প্রতিকূল অবস্থানে এসে দাঁড়ালেন সাহসী কবি শামসুর রাহমান। যিনি স্বাধীনতার অমর কবিতা লিখে কবিতা প্রিয় কোটি মানুষের কাছে কিংবদন্তী হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, স্বীকৃত এবং বিবেচিত। ১৯৭১ সাল থেকেই আমি তাঁর ভক্ত অনুরাগী একজন, যখন আমি পাবনা জেলা স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। পরবর্তীতে প্রথম সাক্ষাৎ পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের এলামনাই নিউজের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং এলামনাই সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কবি শামসুর রাহমানের কাছে প্রথম যাই তাঁর কলাবাগানস্থ ভাষায়। সাথে ছিলেন কবি ভক্ত অনুরাগী ইংরেজী বিভাগের চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, প্রয়াত উপাচার্য ও কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক ড. ফখরুল আলম। বিকাল ৪টায় কবির বাসায় পৌঁছে শুনি, তিনি ঘুমোচ্ছেন। আমরা বসে রইলাম দীর্ঘ ২ ঘন্টা। ঘুম থেকে উঠে আসতেই বিণম্র ক্ষমা প্রার্থনা জানালেন কবি। উঠে দাঁড়িয়ে সবাই তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম। কবি একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। সে সুবাদেই তাঁর কাছে যাওয়া এবং ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এলামনাই সোসাইটির (১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত) সহযোগী সদস্য হিসেবে কবিকে প্রস্তাব দেওয়া। মৃদু হেসে কবি বললেন, ‘আমিতো ক’বছর পড়েছি মাত্র পরীক্ষাতো আর দেওয়া হয়নি তখন।’- ড. মনজুরুল ইসলাম বললেন, ‘তবুও আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনাকে সহযোগী সদস্য করার।’- আমি তখন ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিতব্য প্রথম সংখ্যা এলামনাই নিউজের জন্য কবির কাছে একটা কবিতা চাইলাম। কবি সানন্দে রাজি হলেন। দু’দিন পর যোগাযোগ করতে বললেন। কথামত ঠিকই যোগাযোগ করি এবং একটি নতুন কবিতা ‘ওরা ঘুমিয়ে আছে’ শীর্ষক কবিতাটি হাতে পাই। সম্পাদক হিসেবে সেদিন আমার বুকের ভেতরে এক আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। সে বছর ১৯৮৬ সালে ডিসেম্বর মাসের শেষ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রে ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এলামাই সোসাইটির প্রথম প্রীতি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং কবির সেই অমর কবিতা ‘ওরা ঘুমিয়ে আছে’ এলামনাই নিউজে প্রকাশ পায়। কবি যথাসময়ে প্রীতি সম্মেলনে যোগ দেন। তাঁকে ঘিরে সবার সেকি আনন্দ উল্লাস! জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক খান সারোয়ার মুর্শেদ, অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক ড. আহসানুল হক, অধ্যাপক শামসুদ্দোহা, অধ্যাপক ড. রাজিয়া খান, অধ্যাপক ড. নিয়াজ জামান, অধ্যাপক ড. খন্দকার রেজাউর রহমান, অধ্যাপক নাদেরা বেগম, অধ্যাপক কবি কায়সার হামিদুল হক, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ড. ফখরুল আলম, অধ্যাপক ড. শওকত হোসেন, অধ্যাপক কবি খন্দকার আশরাফ হোসেন, মন্ত্রী পরিষদ সচিব, এম মজিবুল হক, কবি ও সচিব মোফাজ্জল করিম, কবি ও সাংবাদিক আবিদুর রহমান, নাট্যজন রামেন্দ্র মজুমদার, নাট্যজন খায়রুল আলম সবুজ, সমাজসেবী রুহুল আমিন মজুমদার, শিল্পপতি আজম জাহাঙ্গীর চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ারুল হক, অধ্যাপক কবি কাশীনাথ রায়সহ শত শত ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কবিকে সেদিন বিরল সম্মাননা জানান। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে পরদিন সে দৃশ্য ছাপা হলো। তখন একমাত্র বিটিভি’র জাতীয় সংবাদেও সে খবর গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছিল। সে স্মৃতি আজও আমাকে আন্দোলিত করে, সুখ দেয়। ১৯৯৩ সালে বাঙ্গালী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবি শামসুর রাহমানকে ঘিরে আমরা ‘তারুণ্যের উৎসব’ চত্বরজুড়ে উদযাপন করি। ‘তারুণ্যের উৎসব’- ৯৩ এর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে আমি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট উদযাপন কমিটির সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করি অভিনেতা আসলাম শিহির ও গবেষক এবং সংগঠক মোশারফ হোসেনকে। সে সময়কার পরিচিত তারুণ্য ব্যক্তিত্বরাই এই উদযাপন কমিটির সদস্য ছিলেন। এক পর্যায়ে কবির সাথে আমার সখ্যতা বেড়ে যায়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধূমপান ও মাদক বিরোধী ছাত্র সংগঠন- সাস্ক এর সভাপতি এবং বন্ধন: স্বেচ্ছায় রক্তদান সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক। সে সুবাদেই কবিকে সংস্থা দুটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকতে আমন্ত্রণ জানাই এবং একই সাথে কবিকে ধূমপান ছাড়ার বিনীত আহবান করি। কবি সানন্দে ধূমপান ছাড়ার প্রস্তাবনা গ্রহণ করেন এবং সংস্থা দুটির সদস্য ও উপদেষ্টা হিসেবে থাকতে রাজি হন। বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানেও তিনি তখন সানন্দে সক্রিয় অংশ নেন। সে সময় কবির এই সম্পৃক্ততা সাস্ক ও বন্ধনকে আরো শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় করে তোলে, বিশেষ করে তরুণ সমাজের কাছে। যা আজও আমাকে উজ্জীবিত করে থাকে, আমার সকল সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, অধ্যাপনা ও সামাজিক কর্মকান্ডে। একবার কবি এডভোকেট সুলতানা নাহারের বাসায় সমর রায়ের সংগীত সন্ধ্যার আয়োজন করি। কবিকে এতে প্রধান অতিথি হিসেবে পাই। কবি যথা সময়েই বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. শামসুজ্জামান খানকে সাথে করে চলে আসেন। এতে আরো যোগ দেন কবি অধ্যাপক ড. আহসানুল হকসহ কবির অনেক ভক্ত অনুরাগী। সে অনুষ্ঠানেই আয়োজক হিসাবে প্রস্তাবনা রাখি, শামসুর রাহমান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার। কবির সম্মতি মেলে, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী শামসুর রাহমান গবেষণা কেন্দ্রের সভাপতি হিসেবে থাকতে সদয় সম্মতি দিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতা অধ্যাপক ড. আহসানুল হক, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি জামাল আহমেদ, খবর সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান মিজান, কবি ইকবাল আজিজ, কবি সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদসহ অনেকেই সে সময় শামসুর রাহমান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহ যোগালেন। এ নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে খবর, প্রতিবেদন এবং সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়। আজ পর্যন্তও শামসুর রাহমান গবেষণা কেন্দ্র আলোর মুখ দেখেনি বা প্রতিষ্ঠা পায়নি? আমাদের এই ব্যর্থতা, আজও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। বুকের ভেতরে গভীর বেদনা ও দুঃখ জাগাচ্ছে। মাঝে মাঝে এ নিয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা অনুভব করি। বিশেষ করে কবির মৃত্যুদিনগুলোতে। একবার ভারতের বিশিষ্ট কবি ও কথা সাহিত্যিক সুনীল বন্দোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তোমাদের শামসুর রাহমানকে নিয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ভাষায় গবেষণা হলে, তিনি সাহিত্যে নোবেল পদক পেতেন। একথার আলোকে বলতে চাই, বেঁচে থাকতে শামসুর রাহমান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে কি, তাঁর মৃত্যুর পর কোন কালেও কি তা প্রতিষ্ঠা পাবেনা? আজ তাঁর মৃত্যুদিনে (১৭ আগস্ট) সে কথা আবারও গোটা জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি আর প্রিয় কবির জন্য নীরবেই নির্জনে একাকী বসে চোখের জলে, তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি।
আলী নিয়ামত:
সম্পাদক, প্রাক্তনী সংবাদ-এলামনাই নিউজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment