ওরা ৬ জন। দীর্ঘদিন ধরে হদিস নেই। ওদের অন্তর্ধান ঘটনা রহস্যের জালে আটকাপড়ে আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাতায় ওরা নিখোঁজ। স্বজনদের দাবি, ওদের খুন করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেছে। অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া ৬ জন হচ্ছে রাজধানীর যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেন, রাজধানীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলম, নির্মাণ শ্রমিক লীগের তিন নেতা আইয়ুব আলী সর্দার, আকবর আলী সর্দার ও আব্দুর রহমান নিখোঁজের পর সর্বশেষ যাত্রাবাড়ীর ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি কাজী আতাউর রহমান লিটু।
সর্বশেষ নিখোঁজ হয়েছেন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজীরবাগ থেকে কাজী আতাউর রহমান লিটু। তিনি ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। তিনি নিখোঁজ হয়ে যান মাত্র ৫ দিন আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর। লিটুর পরিবারের অভিযোগ, সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ লিটুকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন যুবলীগ নেতা লিয়াকতের পরিবারও।
লিটুর স্ত্রী রাশিদা বেগম গত ২৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করেন। রাশিদা বেগম জিডিতে অভিযোগ করেছেন, ২২ সেপ্টেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আতাউর রহমান দয়াগঞ্জের দিকে যায়। সাদা পোশাকধারী কিছু লোক উঠিয়ে নিয়ে যায় তাঁকে। এ জিডি পুলিশ তদন্ত করেনি বলে পরিবারের পৰ থেকে অভিযোগ করা হয়। অভিযোগ করার পর তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
যাত্রাবাড়ী থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা জানান, আতাউর রহমান লিটুর নিখোঁজের বিষয়টি পুলিশকে অবগত করা হয়েছে। তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট খতিয়ে দেখে তদনত্ম করা হচ্ছে। সর্বশেষ কোন এলাকায় তিনি অবস্থান করেছিলেন তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপর ঘটনা আরও রহস্যাবৃত হয়ে ওঠে। তার পরিবারের পৰ থেকে নিখোঁজ ঘটনার তদন্ত না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় পুলিশের সংশিস্নষ্ট কর্তৃপৰকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ১৩ সেপ্টেম্বর মীরহাজীরবাগের ৩৬৪ নম্বর বাড়ি থেকে ৪২টি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে, সেই মামলার আসামি আতাউর রহমান লিটু। ডিবিও খুঁজছে তাকে। তার কাছে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। তাকে আটক করা গেলে আদালতে হাজির করা হবে। র্যাব ও সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, লিটু নামে কাউকে র্যাব আটক করেনি।
যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেনকে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একজন বানায় বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। তিনি নিখোঁজ হয়েছেন প্রায় দুই বছর। দুই বছরেও তার হদিস মেলেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে, নাকি তারই প্রতিপক্ষ গ্রুপের অপহরণের শিকার হয়েছেন তিনি? এ প্রশ্নের সুরাহা হয়নি অদ্যাবধি। লিয়াকতের পরিবার থেকে দাবি করা হয়েছে, র্যাব পরিচয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা অপহরণ করে তাকে হত্যা করেছে। র্যাব কর্তৃপক্ষ তার পরিবারের এ দাবি বরাবর অস্বীকার করে আসছে। লিয়াকতের স্ত্রী উচ্চ আদালতে তার স্বামীর খোঁজ জানতে চেয়ে রিট করলে এ বিষয়ে আদালত পুলিশের আইজি ও র্যাব মহাপরিচালককে জবাব দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ দুই বাহিনীর প্রধানগণ জানান যে, লিয়াকত নামে কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক বা গ্রেফতার করেনি। ২০০৮ সালের ২৬ নবেম্বর ধানম-ির ২৭ নম্বর রোডের ৪০৫ নম্বর বাড়ির সাউথ প্রাইড এ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলার এ-৩ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে র্যাব পরিচয়ে ৫/৬ জনের একটি সশস্ত্র দল ধরে নিয়ে যায় তাকে। এ ঘটনার পর ধানম-ি থানায় একটি জিডি করেন লিয়াকতের স্ত্রী ফারহানা হোসেন। এ জিডির তদনত্ম করে লিয়াকতকে নিখোঁজ বলেই রিপোর্ট দেয় সংশিস্নষ্ট পুলিশ।
চৌধুরী আলম ঢাকা মহানগরের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। তিনি নিখোঁজ হন গত বছরের ২৫ জুন। রাজধানীর ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে প্রাইভেট কারে ধানম-ি যাওয়ার সময় নিখোঁজ হন তিনি। সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের হাতে আটক হন বলে অভিযোগ করা হয়। গাড়ি থামিয়ে তাকে আটক করে নিয়ে যায় বলে পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। তার নিখোঁজ হওয়ার এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যনত্ম খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। চৌধুরী আলম নিখোঁজের পর শেরেবাংলা নগর থানায় গত বছরের ১ জুলাই একটি অপহরণ মামলা করেন তার ছেলে আবু সাঈদ আলম চৌধুরী হিমু। মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদনত্ম করছে। তদনত্মে চৌধুরী আলমের এখনও কোন হদিস মেলেনি।
নির্মাণ শ্রমিক লীগের তিন নেতা আইয়ুব আলী সর্দার, আকবর আলী সর্দার ও আব্দুর রহমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছেন গত দেড় বছর ধরে। পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, এ তিনজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে র্যাব সদস্যরা। ২০১০ সালের ১৯ মার্চ ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার সানদার জামে মসজিদের পাশ থেকে আকবর আলী সর্দারকে র্যাব-৫ পরিচয় দিয়ে অপহরণ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। আকবর আলী সর্দারের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর চর ধুরাইল ইউনিয়নে। তিনি মাদারীপুর নির্মাণ শ্রমিকলীগের একজন নেতা। তার বড় ভাই আইয়ুব আলী সর্দার র্যাব ও পুলিশের কাছে ভাইয়ের খোঁজ করেছেন। আইয়ুব আলী ৩১ মার্চ এ ঘটনায় একটি মামলা করেন ঠাকুরগাঁও আদালতে। এ ঘটনার পর ঐ বছরের ১৭ মে রাত ১০টার দিকে খিলগাঁও বনশ্রী প্রজেক্ট এলাকায় আইয়ুব আলী খিলগাঁও থানা নির্মাণ শ্রমিক লীগের প্রচার সম্পাদক আব্দুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের আটক করে নিয়ে যায় র্যাব পরিচয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। এরপর থেকে এ দু'জনেরও হদিস মিলছে না।
গোয়েন্দা সংস্থা ও র্যাব সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উর্ধতন কর্মকর্তারা জানান, রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়া ৬ জনের সন্ধানে তদনত্ম করা হচ্ছে। শুধু দেশে কেন, বিদেশেও বছরের পর বছর ধরে নিখোঁজ থাকার পর নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পাওয়ার নজির আছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment